বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ০১:২২ অপরাহ্ন

খোলা সংলাপ -পলক রহমান

খোলা সংলাপ
– পলক রহমান।

# কথামুখ
ইদানিং বেশ কিছুদিন হল সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে অনিয়ম আর বিশৃঙ্খল পরিবেশ দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে আর পারলাম না চুপ করে বসে থাকতে। তাই সমালোচনার পাশাপাশি সমাধানেরও একটু ছোঁয়া রেখে এই লিখাটি লিখলাম। সম্মানিত সকল কবি সাহিত্যিক ও সংগঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি যেন আগামীতে অনুগ্রহপূর্বক বিষয়গুলোর প্রতি তারা সুদৃষ্টি দেন।

বর্তমানে কবি লেখক সমাজে ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট দেয়া নেয়া ও খাঈয়ার প্যাকেট বিতরণ নিয়ে (কখও কখনও টাকার বিনিময়ে) যে অপসংস্কৃতি শুরু হয়েছে তা এখনই বন্ধ করা বা বর্জন করার মানসিকতা তৈরি করা প্রয়োজন। তা না হলে আমাদের সুস্থ ও সৃজনশীল সাহিত্য সংস্কৃতি অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়বে বলে আমার মনে হয়। এ প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আপনিও কিন্তু শামিল হোচ্ছেন। এ অনাকাঙ্ক্ষিত সংস্কৃতিগুলো বন্ধ করা না হলে সমাজ বিনির্মানে সুস্থধারার সংস্কৃতির অভাবে আমরা অন্ধকারে নিমজ্জিত হব। ইদানিং এমন অপসংস্কৃতির ব্যবহার দেখে আমরা রীতিমতো শংকিত হয়ে পড়ছি! এ কেমন ধারা চলছে বিশেষ করে ঢাকা কেন্দ্রীক এই সাহিত্য সংস্কৃতি পাড়ায়?
এমন পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য পরিকল্পনায় ত্রুটি বিচ্যুতি সমাধানের জন্য কিছু খসড়া অব্জারভেশন ও প্রস্তাবনা তুলে ধরলাম।

# উপস্থিতি
কার আয়োজনে কত অধিক সংখ্যক কবি, লেখক, পাঠক সমাগম হল সে নিয়েও যেন প্রতিযোগিতা। উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন প্রলোভন সম্বলিত ব্যানার, প্রচারণা এত বেশী- কিন্তু কেন? যারা প্রকৃতই কবি সাহিত্যিক বা সংস্কৃতি সেবক তাদের ভেতরে টান থাকলে, সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ থাকলে, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকলে এবং সর্বপরি সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশের সুস্থ পরিবেশ থাকলে খেয়ে না খেয়েই আয়োজনে উপস্থিত হবে। আর এর পরেও হাজার বা শত শত উপস্থিতি না হলেও যদি ৫০/৬০ জনই হয় তাই হোক। তবুও প্রকৃত অনুরাগীরাই থাকুক। বর্তমানে পন্যের মত বাজারে কবি-অকবি, ঠুনকো সাহিত্যিক, ভুঁইফোঁড় সংগঠক, সস্তা কবিতা, গল্প ছড়া, বেসুরো গলায় ভুলভাল গান পরিবেশনা থেকে প্রকৃত কবি, কবিতা এবং সংস্কৃতি মুক্তি পাক এটাই কাম্য।

# মঞ্চে আসন
কেউ কেউ যেন আমন্ত্রিত না হয়েও মঞ্চে উঠে একবার আসনে বসতে পেরে ধন্য হতে চায়। সিনিয়র সিটিজেন, কবি লেখক কারা তা বুঝতে চায় না। জায়গা না পেলেও গা ঘেঁষাঘেঁষি করে তাকে যেন বসতেই হবে। যেন মঞ্চে বসতে পারলেই সে বিরাট বড় কবি লেখক বা সংগঠক হয়ে গেল। মঞ্চে চেয়ারে বসে বা রোস্টামে দাঁড়িয়ে একটা ছবি অন্ততঃ তার চাই। ধিক্কার জানাই এই মানসিকতার! আমরা কি ভাবে কাকে সম্মান দেখাব সেটাই শিখিনি। সেই সৃষ্টাচার যেন আজ বিলুপ্ত প্রায়। অথচ কবি সাহিত্যিকরা হবেন ভদ্র, বিনয়ী, মার্জিত এবং দয়ালু। সর্বপরী আয়োজনের চত্বরে সুশৃঙ্খল, ফলে পাঠক সমাজ তাদেরকে এ কারনেই সম্মান দেখাবে। সেটা নয়, বরং ইদানীং যেন মঞ্চে বসার একটা প্রতিযোগিতা পরিলক্ষিত হোচ্ছে। আরে বাবা তুমি নিজেকে মঞ্চে বসার জন্য যোগ্য করো আগে, তখন বলতে হবে না, সকলেই তোমাকে সাদরে আহবান করবে মঞ্চে। তাতেই তোমার সম্মান বৃদ্ধি পাবে।
তাই মঞ্চে খুব বেশী হলে শুধু প্রধান অতিথি আর তার সাথে আরও ৪/৫টি আসন থাকতে পারে। আর এ ছাড়া মঞ্চে উপস্থাপক উপস্থাপিকা ছাড়া কেউ থাকবে না।। বাকি অতিথিগন সময় করে ভোলেন্টিয়ারদের সহযোগিতায় দর্শক সারির প্রথম দিকে নির্ধারিত আসনে বসবেন, সাথে বাকি অন্যান্য আসনে দর্শক ও আমন্ত্রিত বা উপস্থিতি আসন গ্রহন করবেন।

# ক্রেষ্টঃ
যোগ্যতার ভিত্তিতে সাহিত্য সংস্কৃতির কোন বিভাগের জন্য প্রথম নির্বাচিত হলে কেবল তাদেরকে অনুষ্ঠানের দিন মঞ্চে ডেকে ক্রেস্ট প্রদান করে সম্মানিত করা যেতে পারে। অথচ পরিলক্ষিত হোচ্ছে সেই সংগঠনের সকল সদস্যকে ক্রেস্ট দেয়ার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু কেন? সকলকে ক্রেস্ট দিতে হবে কেন? যারা ক্রেস্ট নিচ্ছেন তারাও কি নিজেকে জিজ্ঞাসা করছেন তাকে কেন ক্রেস্ট দেয়া হল, তিনি সেটা পাওয়ার জন্য কি যোগ্য? অবশ্য এখন সস্তা মূল্যের এই সকল ক্রেস্ট দেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংগঠকরাও কথার মারপেঁচে অনেক কৌশল অবলম্বন করছে। ক্রেস্টে লিখছে সাহিত্যে বা সংগঠনে বিশেষ অবদানের জন্য। কি সেই বিশেষ অবদান? সংগঠনে সদস্য হওয়ার পর হয়ত কোনদিন কেউ তার মুখ বা একটা লেখাও দেখেনি বা পড়েনি। অথচ সেই গনহারে ক্রেস্ট বিতরনীর মঞ্চে প্রকৃত যোগ্য কবি, লেখক, অকবি, সংগঠক, কর্মী সকলেই এক কাতারে দাঁড়াচ্ছে, কি দৃষ্টিকটু। এ কেমন ক্রেস্ট বৃষ্টির খেলা, এ কোন ধারার সংস্কৃতি!

বলতে দ্বিধা নেই, আমরা একদিন কোন এক অনুষ্ঠানে বিশৃঙ্খল ভাবে ক্রেষ্ট দেয়ার প্রতিবাদে তা বর্জন করেছি। অথচ অনেকেই তা করতে পারছে না। ক্রেস্ট প্রাপ্তি যে একটা নেশায় পরিনত হয়েছে। পছন্দ হয়নি বিষয়টি গন করে সকলকে শ্যাম যদু মধুদের কাতারে দাঁড় করিয়ে ক্রেস্ট ধরিয়ে দেয়ার জন্য। আমি ক্ষমা চাইছি এজন্য যে সকলেই একই মানের কবি সাহিত্যিক, সংগঠক নয়। সকলকে একই পাল্লায় মাপা উচিৎও নয়। তাহলে এই ক্রেষ্টের ইজ্জত বা মূল্য থাকে না। এবং যোগ্যতার মূল্যায়ন করাও হয় না। তাই এই ন্যাক্কারজনক ক্রেস্ট সংস্কৃতি থেকে আমাদের সকলকে বেরিয়ে আসার জন্য উদাত্ত আহ্বান করছি প্লীজ। সম্মানিত করা এবং তা রক্ষা করা সকলের দায়িত্ব।

# খাওয়া দাওয়া
অনুষ্ঠান স্থলের প্রবেশ গেটেই রেজিস্ট্রেশন করা কবিসাহিত্যিক সংগঠকদের নামের লিষ্ট টিক করে ভোলেন্টিয়ারের মাধ্যমে তখনই দুপুরের বা রাতের খাবারের এবং চা-নাস্তার কুপন দেয়া যেতে পারে। তাতে অনুষ্ঠান চলাকালীন হলের মধ্যে কুপন বিতরণের হট্টগোল এড়ানো যেতে পারে। যা অনাকাংখিত ভাবে তখন অনুষ্ঠানের মান এবং গাম্ভীর্য ক্ষুন্ন করে। কারন যত যাই বলি আমরা কেন জানি না খাবার পাওয়ার জন্য ভীষণ লালায়িত এবং উচ্ছৃঙ্খল! ভদ্রতা রক্ষা করাই জানি না যেন। সিব চাইতে ভালো হয় হলের ভেতরে কোন খাবার পরিবেশন না করা। আরও ভালো হয় খাওয়ার বিষয়টি যদি সম্পূর্ণ রুপে এড়ানো যায়।

# বক্তব্য/কবিতা পাঠ/ আবৃত্তি
তাছাড়া আমরা কবি সাহিত্যিকেরা যেন নিজেদের মর্যাদা ভুলে না যাই। এমনও দেখছি সিনিয়র সিটিজেন এবং কবি হয়েও কেউ কেউ বিশৃঙ্খলার মধ্যেই নিজে থেকে ভিখেরীর মত সময় চেয়ে মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে নির্লজ্জের মত কবিতা আওড়াচ্ছে এবং নিজে নিজেই তা শুনে দাঁত কেলিয়ে স্টেজ থেকে হট্টগোলের মধ্যে নেমে আসছে। আবার কেউ কেউ অনেক অনুরোধ করে শুধু চার লাইন কবিতা পড়বে বলে কুড়ি লাইন কবিতা রিডিং পড়ার মত পড়ে আত্মতুষ্টি নিয়ে মঞ্চত্যাগ করছে। সে বুঝতেই চাইল না যে এতে সে নিজেকেই শুধু নয় গোটা কবি লেখক সমাজকে হেয় প্রতিপন্ন করল। আর এদের কারনেই সমাজে কবি সাহিত্যিকদেরকে মানুষ এত অবজ্ঞার চোখে দেখে এবং দেখছে বলে আমি মনে করি। এ সকল কবি সাহিত্যিকদেরকে আমি তাদের নিজেদেরকে সংশোধন করার জন্য এবং আত্মমর্যাদা বাড়ানোর জন্য যত্নশীল হতে একান্ত অনুরোধ করব। প্লীজ আমাদের কবি লেখক, সাহিত্যিক এবং সংগীত শিল্পীদের মর্যাদাকে তুলে ধরার জন্য সকলেই সকলকে আন্তরিক ভাবে সহযোগিতা করুন।
# প্রাসঙ্গিকতা
অনুষ্ঠানের মেজাজ, প্রতিপাদ্য বা উপলক্ষ্য না বুঝেই আমরা বক্তব্য রাখছি, কবিতার বিষয়ও প্রাসঙ্গিক নয়। অত্যন্ত দুঃখজনক! আর কবিতা যেন কত বড় কবিতা পাঠ করা যায় সেটার একটা প্রতিযোগিতা। ঐ কবি বা বক্তা ভাবতেও চায় না
যে এত বড় কবিতাটা এখানে প্রাসঙ্গিক কি না, বড় কবিতা পাঠ করাতে আরও দুইজন কবি ভাইয়ের কবিতা পড়া থেকে তাকে বঞ্চিত করছি কি না, বিরুক্তির উদ্রেক করছি কিনা, আমার প্রমিত বাংলায় আবৃত্তি দূরের কথা পাঠও হয় কি না ইত্যাদি।
প্রাসঙ্গিকতার কথাটা আরও একটু বলতেই হোচ্ছে। চলছে বসন্ত বরণ কবিতা- পাঠ করছি স্বাধীনতার, চলছে রবীন্দ্র নজরুলের জন্মজয়ন্তী- সেখানে নিজের দলের নেতা-নেত্রীর কথা এসে খাড়া হয়ে গেল। যে কবিতাটা পড়তে হবে মার্জিত ভাবে সেটা অযথাই কন্ঠে বিদ্রোহী হয়ে উঠল মুহুর্তেই। গগন বিদারী অযথা চিতকার ইত্যাদি। আমার খুব জিদ লাগে এ ধরনের মানসিকতার কবি বক্তা লেখকদের দেখলে। মনে হয় মঞ্চ থেকে নামিয়ে দিই। যা হোক পরিবেশকে নান্দনিক ও একঘেয়েমি কাটানোর জন্য খুব হলে সংশ্লিষ্ট কবিতা পাঠ ও আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে দু’তিনটে ভালো কন্ঠের গান পরিবেশনা থাকতে পারে।

# ফটোসেশান
প্রতিটি পর্বের অনুষ্ঠান শেষে ১৫ মিনিটের জন্য সেল্ফি বা ফটোসেশান থাকবে তার আগে নয়। আর কেউ যদি ফটো তুলতেই চায় তাহলে মঞ্চে উঠে একদমই নয়। দূর থেকে জুম করে তুললে তুলবে কিন্তু অসুবিধার সৃষ্টি করবে না।

# ছেঁড়া কথা
অনেক কথা আরও জানানো বা লেখার ইচ্ছে হোচ্ছিল। কিন্তু কেউ পড়তে চায় না ভালো কথা। তাই এটাও বড় হয়ে গেল কি না ভাবছি। অনুরোধ থাকল সকলের কাছে কষ্ট হলেও যেন তবুও একটু চোখ বুলিয়ে নিই। তাতে আমার বা আপনার নয়, সাহিত্য সংস্কৃতি পরিবেশেরই উপকার হবে বৈ ক্ষতি হবে না।
সকলের সুস্থ ও সুন্দর মানসিকতার উন্নয়ন হোক সে কামনা করছি।

– পলক রহমান
সব্যসাচী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




themesbazar_brekingnews1*5k
© All rights reserved © 2020
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD